Sunday 31 January 2021

অন্য শীতের সকাল

অন্য শীতের সকাল

                ~ সৈকত দাস




শীতের সকালের কুয়াশা কাটেনি এখনও।
সাড়ে পাঁচ মাস আগে, হাতের শিকল ভেঙে গেছে,
কিন্তু সেই হাত এখনও মুষ্ঠিবদ্ধ রয়েছে—
যদি কোনো নতুন শত্রু আসে আবার!

এত সকালেও চায়ের দোকানটা খুলে গেছে যথারীতি।
রোজ আসি এখানে, গল্পগুজব হয়— রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে
ধর্ম, শিক্ষা, গণতন্ত্র, মধুসূদন থেকে বিবেকানন্দ… সব!
হাসি আমোদ, খবরের কাগজ,
এই নিয়েই কেটে যায় সকালের প্রথম ভাগ।
বাড়িতে রেডিও নেই, তাই এখানে এসেই শুনি বাসী খবর!

এক-ভাঁড় চা দিতে বলে, আবার গিয়ে বসলাম বেঞ্চে;
মাটির ভাঁড় ছাড়া চা ভালো লাগেনা একদম,
মাটির একটা আলাদা সুগন্ধ আছে না?

ফেরার পথে কুমারটুলিতে যাব একবার,
বাগদেবীর পুজোয় আর পনেরো দিন বাকি।
মাটি দিয়ে কী অপরূপ মূর্তি গড়েন ওঁরা
মৃন্ময়ী প্রতিমা যেন চিন্ময়ী হয়ে ওঠেন তাঁদের নৈপুণ্যে!

যদিও তিন টুকরো হয়ে গেছে এই মাটি,
প্রতিদিন কত লোক ছুটছে উদভ্রান্তের মতো
একদিক থেকে আর এক দিকে— একটু মাটির জন্যে!
শান্তিতে থাকবে বলে টুকরো টুকরো করেই ছাড়লো ওরা,
বুড়োটার কোনো কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না কেউ!
অশান্তি বাড়বে এতে, বলেছিল বুড়ো…
এর পরে আরো কী কী হবে, কী জানি!

চা চলে এসেছে এইসব ভাবতে ভাবতে।
মুখে একরাশ ভয়ের ছাপ নিয়ে
দোকানি আজকের খবরের কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল:
দাদা! শয়তানগুলো এখনও এই মাটি থেকে গেল না!

হাত থেকে পড়ে গেল চায়ের ভাঁড়টা!
ভাঁড়ের মাটিতে রক্তের ছিটে:
একটা পশু কাল খুন করে দিয়েছে বুড়োটাকে!!

©সৈকত দাস
৩১ শে জানুয়ারী, ২০২০
১৬ ই মাঘ, ১৪২৬

Tuesday 26 January 2021

এক ঘোড়সওয়ারের মূর্তি

 এক ঘোড়সওয়ারের মূর্তি


শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে, রোজ দেখি একটা মূর্তিকে—

উদ্ধত ঘোড়ার লাগাম ধরে, তার পিঠে বসে আছেন এক ঘোড়সওয়ার:

স্থির, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে।


রাজনৈতিক নেতার গায়ে একটা মশা বসলেই,

খুন হয়ে যাচ্ছে সেই মশার আশ্রয়স্থলের আশপাশে থাকা

মশার থেকেও ক্ষুদ্র মানুষেরা!

ধর্মস্থান পরিণত হচ্ছে রাজনীতির আড্ডাখানায়,

আর নেতা হয়ে উঠছেন ভগবান…

সেই মূর্তিটা দেখছেন— স্থির শীতল পাথুরে দৃষ্টিতে।


শ্যামবাজার থেকে অনেক দূরে, কিম্বা খুব কাছেই,

যেকোনো রাজ্যে, বা দেশে, বা কোনো মহাদেশে,

প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটি হাত এসে,

মেয়েটির স্তনকে নিষ্পেষিত করেই মিলিয়ে গেল ভিড়ে:

তার আর্তনাদ মিশে গেল ভিড়ের উচ্চ কোলাহলে—

মিশে গেল কি? নাকি সর্বক্ষণ সজাগ ওই মূর্তির পাথরের কানে

তা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বারম্বার?


ম্যানহোলের গভীরে গিয়ে শহরের আবর্জনাকে

তুলে আনেন একজন ‘দলিত’ পুরুষ।

জঞ্জালের সমুদ্রের ভেতরে তাকে টেনে নামায় তাঁর সমাজ,

তাঁর লাশ কখনো হারিয়ে যায়, সেই অন্ধকার দুর্গন্ধের সমুদ্রে।

তখন কি তাঁর শরীরটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়?

তখন কি ওই সৈনিকের পাথরের চোখ, তাঁর স্থির চোখের মধ্যে দিয়ে

দেখতে পায় সমাজের আসল রূপকে?


ঘোড়সওয়ার সৈনিক দাঁড়িয়ে আছেন শ্যামবাজারে,

অনেক উঁচুতে রাখা হয়েছে তাঁকে, ঘোড়াটার এক পা ওঠানো।

তিনি দেখছেন ট্রাক্টর নিয়ে কৃষকের মিছিল,

তিনি দেখছেন সোনার ফাঁস গলায় পরিয়ে তাদেরকে হত্যা করার দৃশ্য,

তিনি দেখছেন বেকারের হাহাকার, অবশেষে আত্মহত্যা,

তিনি দেখছেন সংবাদমাধ্যমের সুলভে বিক্রি হবার উপভোগ্য ঘটনা।

আরো আরো খারাপ ঘটনা দেখছেন তোমার, আমার চোখ দিয়ে—

তবে কি তিনি সৌন্দর্য, প্রেম দেখতে পান না?

শুনতে পান না মধুর সঙ্গীত, কিম্বা জলদগম্ভীর কণ্ঠে আবৃত্তিপাঠ?


যাঁর জন্ম অসুন্দরকে ধ্বংস করার জন্য হয়েছিল,

তিনি কি তাঁর লক্ষ্যকে ভুলে গিয়ে তাকাবেন এদিকে ওদিকে?

তাই স্থির, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই মূর্তি—

নতুন নতুন অজস্র দেহ, বিন্দুর মতো ফুটে উঠছে দিগন্ত রেখায়…

মূর্তিটির মুখে কি এক চিলতে হাসি দেখতে পেলে?


© শ্রী সৈকত

১২ মাঘ, ১৪২৭

২৬ জানুয়ারি, ২০২১

সর্বাধিক পছন্দের লেখা

পুরুষোত্তমের প্রতি

পুরুষোত্তমের প্রতি                                          ~ সৈকত দাস হে চির সুধীর, কৌশলী বীর, তব বাণী ছায়াতলে, অব...