Friday 4 June 2021

লাল কোট

 লাল কোট




সাদা কোটের রক্ত, ‘অমূল্য’ থেকে ‘মূল্যহীন’ হয়ে যায়।

বুলেটের শক্ত মুখ, চলে যায়

মাংস শিরা উপশিরা ধমনীর বেড়াজাল ভেদ করে অনেক ভেতরে—

সেবায় ব্যস্ত মানুষটার দীর্ঘদিনের অযত্নে থাকা দেহটা,

কষ্ট পায় বটে, তবে আরো বেশি কষ্ট পায় তাঁর চেতনা।


আর তাঁরা ঘুরিয়ে একটা চড় মারলেই,

টিআরপিখোর মিডিয়া ছুটে যায় পঙ্গপালের মতন।

‘আক্রমণকারী’ হিসেবে শনাক্ত ক’রে,

কয়েকটা কলমের আঁচড়ে,

শেষ হয়ে যায় তাঁদের কর্তব্যের, তাঁদের জীবিকার সবটা।


তাঁরা মানুষের জন্য সরকারের বিরোধিতা করলে জেলে যাবেন,

তাঁরা পুলিশের মার খাবেন, জনতার মার খাবেন।

তাঁদের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট প্রয়োজন হয় না,

তাঁদের কাছে আত্মরক্ষার জন্য থাকে না কোনো অস্ত্র,

কারণ, তাঁরা সেবক,

সেবকের নাকি শুধু লাথ খাওয়ার অভ্যাসটা থাকতে হয়,

মৃত্যুভয় নয়।


© শ্রী সৈকত

২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮


চিত্রঋণ: কার্টুনিস্ট সতীশ আচার্য্য

Sunday 14 February 2021

আমার প্রেম

 

মা প্রে

                         ~ শ্রী সৈকত


আমার প্রেমের কোনো দিন হয়না।

তীব্র শীতে হিমালয়ের কোলে দাঁড়িয়ে,

প্রতিটা নিঃশ্বাসের মধ্যে প্রেম মিশে থাকে আমার।

বরফের কামড়, প্রেমিকার চুমোর মতো

জড়িয়ে ধরতে চায় বারবার—

আমি প্রেমে থাকি, প্রতিদিন, প্রত্যেক ছোট ঘুমের রাতে।

আমার প্রেম, ঘাম হয়ে ঝরে পড়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলের

প্রবল রুদ্র সূর্যতাপে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি অস্ত্র হাতে।

আমার প্রেম, উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে সোজা দাঁড়িয়ে থাকে,

মেরুদন্ড শক্ত করে, দুই কাঁধে চেপে থাকে গুরুদায়িত্ব,

উড়ে যায় বিমানের পাখা হয়ে, আমার ভালোবাসা।


আমার প্রেম ঝলসে ওঠে, শত্রুর মাথার খুলি ভেদ করে

চলে যায় দূরে… দেশের অখণ্ডতা, আমার প্রেম হয়ে

স্নিগ্ধ সুবাস ছড়ায় রাতের তারাদের ফাঁকে ফাঁকে।

আমার বুকের রক্ত, গোলাপ হয়ে ফুটে থাকে, আমার সমাধির পাশে,

তিনটে রঙে রাঙা প্রেম, বয়ে চলে সিন্ধু, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র দিয়ে।


আমার প্রেমের কোনো কবিতা লিখিনি আমি,

অসংখ্য কবির কলমে তুমি দেখেছ আমার প্রেমের ছবি:

অগণ্য মানুষের কন্ঠ যখন গেয়ে ওঠে ,

“জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে, ভারতভাগ্যবিধাতা…”,

কন্যাকুমারী থেকে লাদাখ পর্যন্ত শিহরিত হয়ে ওঠে

আমার প্রেম, ভারতবর্ষ, প্রেমের পুণ্যক্ষেত্র।


© শ্রী সৈকত

১ ফাল্গুন, ১৪২৭

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

Sunday 31 January 2021

অন্য শীতের সকাল

অন্য শীতের সকাল

                ~ সৈকত দাস




শীতের সকালের কুয়াশা কাটেনি এখনও।
সাড়ে পাঁচ মাস আগে, হাতের শিকল ভেঙে গেছে,
কিন্তু সেই হাত এখনও মুষ্ঠিবদ্ধ রয়েছে—
যদি কোনো নতুন শত্রু আসে আবার!

এত সকালেও চায়ের দোকানটা খুলে গেছে যথারীতি।
রোজ আসি এখানে, গল্পগুজব হয়— রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে
ধর্ম, শিক্ষা, গণতন্ত্র, মধুসূদন থেকে বিবেকানন্দ… সব!
হাসি আমোদ, খবরের কাগজ,
এই নিয়েই কেটে যায় সকালের প্রথম ভাগ।
বাড়িতে রেডিও নেই, তাই এখানে এসেই শুনি বাসী খবর!

এক-ভাঁড় চা দিতে বলে, আবার গিয়ে বসলাম বেঞ্চে;
মাটির ভাঁড় ছাড়া চা ভালো লাগেনা একদম,
মাটির একটা আলাদা সুগন্ধ আছে না?

ফেরার পথে কুমারটুলিতে যাব একবার,
বাগদেবীর পুজোয় আর পনেরো দিন বাকি।
মাটি দিয়ে কী অপরূপ মূর্তি গড়েন ওঁরা
মৃন্ময়ী প্রতিমা যেন চিন্ময়ী হয়ে ওঠেন তাঁদের নৈপুণ্যে!

যদিও তিন টুকরো হয়ে গেছে এই মাটি,
প্রতিদিন কত লোক ছুটছে উদভ্রান্তের মতো
একদিক থেকে আর এক দিকে— একটু মাটির জন্যে!
শান্তিতে থাকবে বলে টুকরো টুকরো করেই ছাড়লো ওরা,
বুড়োটার কোনো কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না কেউ!
অশান্তি বাড়বে এতে, বলেছিল বুড়ো…
এর পরে আরো কী কী হবে, কী জানি!

চা চলে এসেছে এইসব ভাবতে ভাবতে।
মুখে একরাশ ভয়ের ছাপ নিয়ে
দোকানি আজকের খবরের কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল:
দাদা! শয়তানগুলো এখনও এই মাটি থেকে গেল না!

হাত থেকে পড়ে গেল চায়ের ভাঁড়টা!
ভাঁড়ের মাটিতে রক্তের ছিটে:
একটা পশু কাল খুন করে দিয়েছে বুড়োটাকে!!

©সৈকত দাস
৩১ শে জানুয়ারী, ২০২০
১৬ ই মাঘ, ১৪২৬

Tuesday 26 January 2021

এক ঘোড়সওয়ারের মূর্তি

 এক ঘোড়সওয়ারের মূর্তি


শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে, রোজ দেখি একটা মূর্তিকে—

উদ্ধত ঘোড়ার লাগাম ধরে, তার পিঠে বসে আছেন এক ঘোড়সওয়ার:

স্থির, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে।


রাজনৈতিক নেতার গায়ে একটা মশা বসলেই,

খুন হয়ে যাচ্ছে সেই মশার আশ্রয়স্থলের আশপাশে থাকা

মশার থেকেও ক্ষুদ্র মানুষেরা!

ধর্মস্থান পরিণত হচ্ছে রাজনীতির আড্ডাখানায়,

আর নেতা হয়ে উঠছেন ভগবান…

সেই মূর্তিটা দেখছেন— স্থির শীতল পাথুরে দৃষ্টিতে।


শ্যামবাজার থেকে অনেক দূরে, কিম্বা খুব কাছেই,

যেকোনো রাজ্যে, বা দেশে, বা কোনো মহাদেশে,

প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটি হাত এসে,

মেয়েটির স্তনকে নিষ্পেষিত করেই মিলিয়ে গেল ভিড়ে:

তার আর্তনাদ মিশে গেল ভিড়ের উচ্চ কোলাহলে—

মিশে গেল কি? নাকি সর্বক্ষণ সজাগ ওই মূর্তির পাথরের কানে

তা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বারম্বার?


ম্যানহোলের গভীরে গিয়ে শহরের আবর্জনাকে

তুলে আনেন একজন ‘দলিত’ পুরুষ।

জঞ্জালের সমুদ্রের ভেতরে তাকে টেনে নামায় তাঁর সমাজ,

তাঁর লাশ কখনো হারিয়ে যায়, সেই অন্ধকার দুর্গন্ধের সমুদ্রে।

তখন কি তাঁর শরীরটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়?

তখন কি ওই সৈনিকের পাথরের চোখ, তাঁর স্থির চোখের মধ্যে দিয়ে

দেখতে পায় সমাজের আসল রূপকে?


ঘোড়সওয়ার সৈনিক দাঁড়িয়ে আছেন শ্যামবাজারে,

অনেক উঁচুতে রাখা হয়েছে তাঁকে, ঘোড়াটার এক পা ওঠানো।

তিনি দেখছেন ট্রাক্টর নিয়ে কৃষকের মিছিল,

তিনি দেখছেন সোনার ফাঁস গলায় পরিয়ে তাদেরকে হত্যা করার দৃশ্য,

তিনি দেখছেন বেকারের হাহাকার, অবশেষে আত্মহত্যা,

তিনি দেখছেন সংবাদমাধ্যমের সুলভে বিক্রি হবার উপভোগ্য ঘটনা।

আরো আরো খারাপ ঘটনা দেখছেন তোমার, আমার চোখ দিয়ে—

তবে কি তিনি সৌন্দর্য, প্রেম দেখতে পান না?

শুনতে পান না মধুর সঙ্গীত, কিম্বা জলদগম্ভীর কণ্ঠে আবৃত্তিপাঠ?


যাঁর জন্ম অসুন্দরকে ধ্বংস করার জন্য হয়েছিল,

তিনি কি তাঁর লক্ষ্যকে ভুলে গিয়ে তাকাবেন এদিকে ওদিকে?

তাই স্থির, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই মূর্তি—

নতুন নতুন অজস্র দেহ, বিন্দুর মতো ফুটে উঠছে দিগন্ত রেখায়…

মূর্তিটির মুখে কি এক চিলতে হাসি দেখতে পেলে?


© শ্রী সৈকত

১২ মাঘ, ১৪২৭

২৬ জানুয়ারি, ২০২১

Friday 11 September 2020

 


বড্ড দুঃখ

                               ~ শ্রী সৈকত


বাঙালি দুঃখবিলাস ভালোবাসে।

তার ফ্রিজে ঢোকানো লালশাক আছে,

কনভেন্টে পড়া বাচ্চা আছে,

ফাইফরমাস খাটা কাজের লোক আছে একটা,

তবু সে দুঃখবিলাস ভালোবাসে।

বাঙালির দেশপ্রেম আছে, জাতিপ্রেম আছে,

ধর্না আছে, পাড়ার প্রেম আছে,

পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই উত্তর দক্ষিণ ভাগ আছে,

বাঙালি, বাংলা বলতে কলকাতা বোঝে,

আর কলকাতা বলতে বুদ্ধিজীবী,

কাজ না পাওয়া বেকারের প্রেম দেখলে চোখ জ্বালা করে,

পরনিন্দা কে না করে? বাঙালিও করে,

তবে দুঃখ আর সুখের মধ্যে বেছে নিতে বললে—

বাঙালি সুখটা চেটে নিয়ে দুঃখবিলাস ভালোবাসে।

রসগোল্লাটা ভালো ছিল, তবে স্বাদটা থাকলো না বেশিক্ষণ— দুঃখ।

প্রেমটা জমেছিল, কিন্তু ছেলেটা ওর কথা মতন চলছিল না

তাই ব্রেকআপ— দুঃখ।

নিজের বাড়িতে বউ রেখে কলেজের প্রেমিকার সাথে

পরকীয়া করতে পারছে না— দুঃখ!

ইত্যাদি সব বিভৎস করুণ দুঃখ নিয়ে বাঙালি হাঁটছে,

হাঁটছে তো হাঁটছেই, থামবার নামই নেই!

আর কাব্য করে করে ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই দুঃখমালা।


আর যেসব বাঙালি সত্যি সত্যিই দুঃখে আছে,

তাদের মাথায় খাবারের চিন্তা,

বাচ্চাকে পড়ানোর চিন্তা,

মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসার টাকার চিন্তা,

বর্ষার সময় ফুটো ছাদের নীচে বসে চিন্তা,

কাজ খুঁজে খুঁজে খালি হাতে বাড়ি ফিরে প্রতিরাতে দুশ্চিন্তা—

বিলাসের সময় পাবে কখন বলুন তো!

আপনার অঢেল সময়, 

করুন, দুঃখবিলাস করুন।


© শ্রী সৈকত

২৫ ভাদ্র, ১৪২৭

১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

লাশ



লাশ

              ~ শ্রী সৈকত

ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরের মাঝে
কয়েকশ’ বিকৃত লাশ— মানুষের লাশ।
পচে ফুলে ওঠা, কোনোটার চোখ খুবলানো,
কোনোটার পা কাটা, হাত আধখাওয়া।
জঙ্গলের শেয়াল আর আকাশের শকুনেরা
অনেকদিন পর খাচ্ছে পেট ভরে, ফেলে ছড়িয়ে।
তাদের বাপ-ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনেছিল তারা,
বহুদিন আগে, দাঙ্গায় মরা মানুষগুলোকে
তৃপ্তি করে খেয়েছিল পূর্বপুরুষেরা।
এরা মানুষ, এরা যুদ্ধ করে মন্দির আর মসজিদের নামে,
এরা দাঙ্গা করে, দাঙ্গার পরের গঙ্গা, তার রক্তগোলা জল নিয়ে
সাগরের কাছে যেতে কুণ্ঠাবোধ করে, তবু যেতে হয়—
পবিত্রতার শিক্ষা দিতে পারেনি সে সন্তানদেরকে।
দাঙ্গার সময়ে কোনো কোনো ‘মানুষ’ বেঁচেও থাকে,
রামকে নিজের বাড়িতে রেখে বাঁচাতে গিয়ে
খুনে তলোয়ারের সামনে প্রাণ দেয় ইকবাল,
ছোটবেলার বন্ধু মকবুলকে বাঁচাতে বুক পেতে দেয় ব্রাহ্মণের ছেলে নিবারণ—
তারা তো মরে না, বেঁচে থাকে সময়ের বুকে,
অমাবস্যার শ্মশানে একফোঁটা জোনাকির মতো!
শেয়াল শকুনেরা অবশ্য জানে না অত কথা,
বোঝে না তারা: খিদে পেলেই লাশ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে রোজ রোজ,
তবে রোজ তো আর দাঙ্গা হয় না,
তবে ধর্ষিত লাশ, না-খেতে-পেয়ে মরা লাশ পেয়ে যায় কেউ কেউ।
ওদিকে সংবিধানের শব্দগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে জ্বলতে
উপহাস করতে থাকে তাদেরকে, কিম্বা হয়তো নিজেদেরই!

© শ্রী সৈকত
২৫ ভাদ্র, ১৪২৭
১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বহরমপুর


সর্বাধিক পছন্দের লেখা

পুরুষোত্তমের প্রতি

পুরুষোত্তমের প্রতি                                          ~ সৈকত দাস হে চির সুধীর, কৌশলী বীর, তব বাণী ছায়াতলে, অব...