এক ঘোড়সওয়ারের মূর্তি
শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে, রোজ দেখি একটা মূর্তিকে—উদ্ধত ঘোড়ার লাগাম ধরে, তার পিঠে বসে আছেন এক ঘোড়সওয়ার:
স্থির, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে।
রাজনৈতিক নেতার গায়ে একটা মশা বসলেই,
খুন হয়ে যাচ্ছে সেই মশার আশ্রয়স্থলের আশপাশে থাকা
মশার থেকেও ক্ষুদ্র মানুষেরা!
ধর্মস্থান পরিণত হচ্ছে রাজনীতির আড্ডাখানায়,
আর নেতা হয়ে উঠছেন ভগবান…
সেই মূর্তিটা দেখছেন— স্থির শীতল পাথুরে দৃষ্টিতে।
শ্যামবাজার থেকে অনেক দূরে, কিম্বা খুব কাছেই,
যেকোনো রাজ্যে, বা দেশে, বা কোনো মহাদেশে,
প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটি হাত এসে,
মেয়েটির স্তনকে নিষ্পেষিত করেই মিলিয়ে গেল ভিড়ে:
তার আর্তনাদ মিশে গেল ভিড়ের উচ্চ কোলাহলে—
মিশে গেল কি? নাকি সর্বক্ষণ সজাগ ওই মূর্তির পাথরের কানে
তা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বারম্বার?
ম্যানহোলের গভীরে গিয়ে শহরের আবর্জনাকে
তুলে আনেন একজন ‘দলিত’ পুরুষ।
জঞ্জালের সমুদ্রের ভেতরে তাকে টেনে নামায় তাঁর সমাজ,
তাঁর লাশ কখনো হারিয়ে যায়, সেই অন্ধকার দুর্গন্ধের সমুদ্রে।
তখন কি তাঁর শরীরটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়?
তখন কি ওই সৈনিকের পাথরের চোখ, তাঁর স্থির চোখের মধ্যে দিয়ে
দেখতে পায় সমাজের আসল রূপকে?
ঘোড়সওয়ার সৈনিক দাঁড়িয়ে আছেন শ্যামবাজারে,
অনেক উঁচুতে রাখা হয়েছে তাঁকে, ঘোড়াটার এক পা ওঠানো।
তিনি দেখছেন ট্রাক্টর নিয়ে কৃষকের মিছিল,
তিনি দেখছেন সোনার ফাঁস গলায় পরিয়ে তাদেরকে হত্যা করার দৃশ্য,
তিনি দেখছেন বেকারের হাহাকার, অবশেষে আত্মহত্যা,
তিনি দেখছেন সংবাদমাধ্যমের সুলভে বিক্রি হবার উপভোগ্য ঘটনা।
আরো আরো খারাপ ঘটনা দেখছেন তোমার, আমার চোখ দিয়ে—
তবে কি তিনি সৌন্দর্য, প্রেম দেখতে পান না?
শুনতে পান না মধুর সঙ্গীত, কিম্বা জলদগম্ভীর কণ্ঠে আবৃত্তিপাঠ?
যাঁর জন্ম অসুন্দরকে ধ্বংস করার জন্য হয়েছিল,
তিনি কি তাঁর লক্ষ্যকে ভুলে গিয়ে তাকাবেন এদিকে ওদিকে?
তাই স্থির, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই মূর্তি—
নতুন নতুন অজস্র দেহ, বিন্দুর মতো ফুটে উঠছে দিগন্ত রেখায়…
মূর্তিটির মুখে কি এক চিলতে হাসি দেখতে পেলে?
© শ্রী সৈকত
১২ মাঘ, ১৪২৭
২৬ জানুয়ারি, ২০২১