Friday 7 February 2020

আমার ভারতবর্ষ

আমা ভারবর্ষ

                           ~ শ্রী সৈকত


আমার ভারতবর্ষ, কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা কোনো ভূখণ্ড নয়।
আমার ভারতবর্ষ, মানে শুধু সমাজতান্ত্রিক আর
ধর্মের প্রতি পক্ষপাতহীন গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের দেশ,
যে দেশের বেশিরভাগ মানুষ, গণতন্ত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে
পাঁচ বছরে একবার মতদানের কথা ভাবেন— তা নয়।
আমার ভারতবর্ষ মানে, শুধু ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭ এ
কিম্বা ১৯৪৮, ৪৯, ৫১ তে কী কী হয়েছিল—
তোতাপাখির মতো সেই ইতিহাসকে মুখস্থ বলা নয়।
আমার ভারতবর্ষ মানে, ১৯৮৪ কিম্বা ২০০২ এর স্মৃতি,
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর অত্যাচার কিম্বা বাবরি ধ্বংস নয়।

আমার ভারতবর্ষ, পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক গভীরে
শিকড় হয়ে গেঁথে আছে;— বিশ্বের ভবিষ্যতের অনেক উর্ধ্বে
ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ফলফুল, কচি সবুজ পাতা, নমনীয় ডালপালা।
নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, শুণ্যবাদী থেকে শুরু করে
নিরীশ্বরবাদী আর আস্তিকের এই পুণ্যভূমি।
চার্বাককে ‘মহর্ষি’ বলে ডাকা হয় এই দেশে!
নিজের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে পেয়ে ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি’ বলে ওঠে
এই দেশ— আমি ঈশ্বর, একথা বলতে ভয় পেতে হয় না এই দেশে।

এই দেশের উপনিষদের ঋষি, তাঁর মেঘমন্দ্রিত স্বরে
সারা বিশ্বকে বলে চলেছেন, ভয় নেই, নির্ভীক হও!
তোমার ইচ্ছাশক্তির সামনে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে
দুঃখের মহাপর্বত, তুমি মানুষ, তুমি ঈশ্বর, তুমি সর্বশক্তিমান!
‘ঘনীভূত ভারতবর্ষ’ ‘অশরীরী বাণী’ হয়ে বলে ওঠেন:
“ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছোনো পর্যন্ত থেমো না।”
ভগৎ সিং থেকে মোহনদাস গান্ধী, অরবিন্দ থেকে সুভাষ,
প্রীতিলতা আর বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী, ক্ষুদিরামের পাশে বাঘাযতীন—
এরাই আমার ভারতবর্ষ, চির অম্লান, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের এই দেশ।

এ দেশের আত্মা, চকিতে ফিরে তাকায়, চোখে তার
আন্দামানের আগ্নেয়গিরি, কোলে তুলে নেয়
আট বছরের নিষ্পাপ মৃত শিশুকে,
বিকৃতকামের অত্যাচার সহ্য করতে করতে যে মেয়েটা
পোকায় খাওয়া ফুলের মতন ঝরে পড়েছে তার বুকে!
শুধু কয়েকটা কাঁটাতারের জন্য যখন তার ছেলেটা
মরণোন্মুখ সিংহের মতো শেষবার গর্জন করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে;
আর তারপর, তার দেহকে তেরঙ্গায় জড়িয়ে চলে রাজনৈতিক পাশাখেলা,
মাথা নত সেই মায়ের চোখের জল, সিন্ধু আর জাহ্নবী হয়ে
মিশে যায় আরব সাগর আর বঙ্গোপসাগরের জলে!

আমার ভারতবর্ষে বিসমিল্লার সানাই শুনতে আসেন কাশীর বিশ্বনাথ,
বড়ে গুলাম আলী খান গেয়ে ওঠেন সরস্বতী বন্দনা—
‘রাম’ উচ্চারণ করার জন্য নিজের দেশ ছেড়ে ভারতে আসেন তিনি!
আযানের শব্দে ঘুম ভেঙে বেদ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা
শুরু করে উপনিষদের পাঠ, উচ্চারণ করে—
‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ…’

আমার ভারতবর্ষ, কবিতার কয়েকটা লাইন, কিম্বা নেতাদের শব্দছক নয়,
আমার ভারতবর্ষ তৈরী করতে জানে না কোনো আতঙ্কসৃষ্টিকারীকে—
তলোয়ারের আস্ফালনে অন্যকে— অন্নকে ধ্বংস করতে জানে না সে
আমার ভারতবর্ষ, হেমন্তের শিশির হয়ে টুপ করে ঝরে পড়ে ঘাসের মাথায়,
আমার ভারতবর্ষ বলে: আমি ভালোবাসি।—
বলে: তুমি পেরেছ ভালোবাসতে, কোনোদিন?!

© শ্রী সৈকত
২৩ মাঘ, ১৪২৬
বহরমপুর

No comments:

Post a Comment

সর্বাধিক পছন্দের লেখা

পুরুষোত্তমের প্রতি

পুরুষোত্তমের প্রতি                                          ~ সৈকত দাস হে চির সুধীর, কৌশলী বীর, তব বাণী ছায়াতলে, অব...