Saturday 15 February 2020

একটা ছেলে

একটা ছেলে
                                  ~ সৈকত দাস



একটা ছেলে পদ্য লেখে, হরেক রকম ছন্দে,
একটা ছেলে মেতেই থাকে আম কাঁঠালের গন্ধে।
সেই ছেলেটাই চুপটি করে জানলা ধারে বসে,
বাড়ির পাশের পুকুর দেখে, দেখে শিশির ঘাসে।
চারদিকে তার গণ্ডি আঁকা, নাই বেরোনোর জো,
জামায় পকেট না থাকলে, বাপরে কী রাগ গো!
সেই ছেলেটা বড্ড গরীব, সেই ছেলেটাই ধনী,
জানতো কি কেউ, কাল হবে সে, প্রথম সারির জ্ঞানী?
গণিত ধাঁধায় কূল না পেয়ে, মাথায় লাগে গোল,
আর সেই মাথাতেই আসছে দেখো হরেক গানের বোল!
সেই ছেলেটা অনেক বড়ো, সেই ছেলেটা ছোটো,
তোমায়-আমায় রোজ সে বলে, “মানুষ হয়ে ওঠো!”
সেই ছেলেটা লড়তে শেখায় ঝড় বাদলের রাতে,
কষ্ট পেলে, সেই ছেলেটাই, হাঁটতে থাকে সাথে।
নামখানা তার অনেক বড়ো, তারচে’ বড়ো মন,
কাউকে সে তো পর করেনি, সবার আপনজন।
আজ যদি কেউ তোমায় দেখে চোখ রাঙাতে চায়,
কেউ যদি তোর দুহাত থেকে খেলনা কেড়ে নেয়;
সেই ছেলেটার হাত ধরে তুই তুলবি বিশাল ঝড়,
চিত্ত হেথা ভয়শূন্য, নাই কোনো ভয়ডর,
তোর নাই কোনো ভয়ডর।

© সৈকত দাস
২ রা ফাল্গুন, ১৪২৬
১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০

Wednesday 12 February 2020

রজনীগন্ধা দিও

রজনীগন্ধা দিও
                ~ শ্রী সৈকত
                    


যদি কখনো ভালোবেসে, কিছু দিতে চাও আমাকে,
যদি কখনো আমার দেহ-মন-বুদ্ধি ছাড়াও, শুধু আমার ‘আমি’কে,
আমার সবটুকুকে ভালোবাসতে পারো,
তবে দিও না গোলাপ কিম্বা অন্য কোনো রঙিন ফুলের তোড়া—
শুধু একগুচ্ছ রজনীগন্ধা দিও।

যদি কবির কোনো জন্মদিনে, মনে পড়ে যায় তাকে,
যদি কিছু দিতে, সত্যিই খুব মন চায়,
তবে দিও না কোনো ঝলমলে দামী পোশাক, হাতঘড়ি কিম্বা
বাহারী কোনো সৌখিন জিনিস—
নিজের হাতে করে, তার হাতে তুলে দিও
মন ভরিয়ে দেওয়া একগুচ্ছ সাদা ফুল— রজনীগন্ধা।

গোলাপের সুবাস, আমি পাইনি কোনোদিনই;
অন্যদেরকে গোলাপে মাতোয়ারা হয়ে যেতে দেখে,
আমি অবাক হয়ে যাই বারবার;
তাই যদি কখনো ভালোবাসো, যদি রাখো মনের মাঝখানের
কোনো বিশেষ স্থানে; আর যদি সেই প্রেম,
প্রকাশিত হওয়ার জন্য, খোঁজে কোনো মাধ্যম:
রক্ত-লাল গোলাপ, নিতান্তই অসমর্থ, নিষ্ক্রিয় সে দায়িত্ব বহনে—
সব রঙ মিলে যায় যে সাদা রঙে, বেঁধে ফেলো আমাকে
সেই রজনীগন্ধার মোহময়ী সুগন্ধে।

একদিন হঠাৎ, কাউকে কিছু না বলেই, ছুটি নিয়ে নেবে
এই কণ্ঠ, কলম, আর এই শরীর,
থেমে যাবে যত গান, আর উচ্চস্বরে তীক্ষ্ম কবিতা পাঠ,
মুছে যাবো হয়তো বা তোমার স্মৃতি থেকেও…
তবু, চলে যাওয়ার পর, যদি কখনো আনমনে
চোখ আর্দ্র হয়ে আসে তোমার—
কয়েকটা পয়সা, ওই গরীব ফুলওয়ালি মা’কে দিয়ে,
নিয়ে এসো একটা রজনীগন্ধার মালা:
মনে হলে, পরে নিও নিজের গলায়—
যেখানে হয়তো থেকে যাব আমি, চিরকালের জন্য, অব্যক্ত হয়ে!

© শ্রী সৈকত
২৮ শে মাঘ, ১৪২৬
কলকাতা

Friday 7 February 2020

আমার ভারতবর্ষ

আমা ভারবর্ষ

                           ~ শ্রী সৈকত


আমার ভারতবর্ষ, কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা কোনো ভূখণ্ড নয়।
আমার ভারতবর্ষ, মানে শুধু সমাজতান্ত্রিক আর
ধর্মের প্রতি পক্ষপাতহীন গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের দেশ,
যে দেশের বেশিরভাগ মানুষ, গণতন্ত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে
পাঁচ বছরে একবার মতদানের কথা ভাবেন— তা নয়।
আমার ভারতবর্ষ মানে, শুধু ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭ এ
কিম্বা ১৯৪৮, ৪৯, ৫১ তে কী কী হয়েছিল—
তোতাপাখির মতো সেই ইতিহাসকে মুখস্থ বলা নয়।
আমার ভারতবর্ষ মানে, ১৯৮৪ কিম্বা ২০০২ এর স্মৃতি,
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর অত্যাচার কিম্বা বাবরি ধ্বংস নয়।

আমার ভারতবর্ষ, পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক গভীরে
শিকড় হয়ে গেঁথে আছে;— বিশ্বের ভবিষ্যতের অনেক উর্ধ্বে
ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ফলফুল, কচি সবুজ পাতা, নমনীয় ডালপালা।
নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, শুণ্যবাদী থেকে শুরু করে
নিরীশ্বরবাদী আর আস্তিকের এই পুণ্যভূমি।
চার্বাককে ‘মহর্ষি’ বলে ডাকা হয় এই দেশে!
নিজের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে পেয়ে ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি’ বলে ওঠে
এই দেশ— আমি ঈশ্বর, একথা বলতে ভয় পেতে হয় না এই দেশে।

এই দেশের উপনিষদের ঋষি, তাঁর মেঘমন্দ্রিত স্বরে
সারা বিশ্বকে বলে চলেছেন, ভয় নেই, নির্ভীক হও!
তোমার ইচ্ছাশক্তির সামনে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে
দুঃখের মহাপর্বত, তুমি মানুষ, তুমি ঈশ্বর, তুমি সর্বশক্তিমান!
‘ঘনীভূত ভারতবর্ষ’ ‘অশরীরী বাণী’ হয়ে বলে ওঠেন:
“ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছোনো পর্যন্ত থেমো না।”
ভগৎ সিং থেকে মোহনদাস গান্ধী, অরবিন্দ থেকে সুভাষ,
প্রীতিলতা আর বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী, ক্ষুদিরামের পাশে বাঘাযতীন—
এরাই আমার ভারতবর্ষ, চির অম্লান, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের এই দেশ।

এ দেশের আত্মা, চকিতে ফিরে তাকায়, চোখে তার
আন্দামানের আগ্নেয়গিরি, কোলে তুলে নেয়
আট বছরের নিষ্পাপ মৃত শিশুকে,
বিকৃতকামের অত্যাচার সহ্য করতে করতে যে মেয়েটা
পোকায় খাওয়া ফুলের মতন ঝরে পড়েছে তার বুকে!
শুধু কয়েকটা কাঁটাতারের জন্য যখন তার ছেলেটা
মরণোন্মুখ সিংহের মতো শেষবার গর্জন করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে;
আর তারপর, তার দেহকে তেরঙ্গায় জড়িয়ে চলে রাজনৈতিক পাশাখেলা,
মাথা নত সেই মায়ের চোখের জল, সিন্ধু আর জাহ্নবী হয়ে
মিশে যায় আরব সাগর আর বঙ্গোপসাগরের জলে!

আমার ভারতবর্ষে বিসমিল্লার সানাই শুনতে আসেন কাশীর বিশ্বনাথ,
বড়ে গুলাম আলী খান গেয়ে ওঠেন সরস্বতী বন্দনা—
‘রাম’ উচ্চারণ করার জন্য নিজের দেশ ছেড়ে ভারতে আসেন তিনি!
আযানের শব্দে ঘুম ভেঙে বেদ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা
শুরু করে উপনিষদের পাঠ, উচ্চারণ করে—
‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ…’

আমার ভারতবর্ষ, কবিতার কয়েকটা লাইন, কিম্বা নেতাদের শব্দছক নয়,
আমার ভারতবর্ষ তৈরী করতে জানে না কোনো আতঙ্কসৃষ্টিকারীকে—
তলোয়ারের আস্ফালনে অন্যকে— অন্নকে ধ্বংস করতে জানে না সে
আমার ভারতবর্ষ, হেমন্তের শিশির হয়ে টুপ করে ঝরে পড়ে ঘাসের মাথায়,
আমার ভারতবর্ষ বলে: আমি ভালোবাসি।—
বলে: তুমি পেরেছ ভালোবাসতে, কোনোদিন?!

© শ্রী সৈকত
২৩ মাঘ, ১৪২৬
বহরমপুর

Thursday 6 February 2020

টিফিন কৌটোর দেশ

টিফি কৌটো দেশ
                                         ~ শ্রী সৈকত



দেশটা আমার উন্নত খুব, পৌঁছে গেছে মার্সে;
কৃষক থাকে আধপেটা আর মন্ত্রীরা খায় পারশে।
দেশটা আমার মেয়েকে পড়ায়, মেয়েকে বাঁচায় বলছে,
দিনে ষাটখানা ধর্ষণ হয়! নতুন ভারত টলছে।
দেশটা আমার শিক্ষা-দীক্ষা উছলে উছলে দিচ্ছে;
চাকরি খোঁজে শিক্ষিতরা হন্যে হয়ে ঘুরছে।
রাস্তার পাশে খোলা কল থেকে গঙ্গা যমুনা বইছে,
(আবার) কথায় দূষণ, কাজেও দূষণ, বাতাস দূষণ হচ্ছে।
দেশটা আমার সিংহে চড়া মাকে পুজো করে,
লাইব্রেরীতে ঢুকেই পুলিশ, ছাত্র পেটায় ধরে।
উৎসবে আর উল্লাসেতে দেশের ছেলেমেয়ে—
কৌটো খুলে খাবার দেখে, পেটায় লাঠি দিয়ে!
পাকস্থলীর মধ্যে ওরা জাতের গন্ধ ঠিক পায়,
নইলে কি আর গোবর দিয়ে রেডিয়েশন আটকায়?
ক্যানসারের ওই ওষুধ খুঁজে দিনের পরে দিন যায়,
আরে বিশেষ প্রাণীর মূত্র খেলেই সব বিলকুল ঠিক হ্যায়!
তুই কি জানিস সবার প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি
স্টার্টেছিলাম এই আমরাই, গণেশদাকে ধরি!
কী বললি তুই, কোন সুশ্রুত পাল্টেছিলেন নাক—
সেটাই নাকি প্রথম ইভেন্ট? তুই চুপচাপ থাক!
মহাভারতে ইন্টারনেট, সোনার গরু প্রিয়,
গোডসে আবার দেশভক্ত, ভারতরত্ন দিও
(তাকে ভারতরত্ন দিও, তাকে ভারতরত্ন দিও)!
সাভারকরের ভারের চোটে উল্টে পড়ে গেলাম,
নিজেকে নিজেই নাম দিয়েছেন, ‘বীর’ বাহাদুর সেলাম!
গোলমালের এই মজার দেশে চক্ষু বুঝে থাকি,
যাক না বাবা গোল্লায় দেশ, কী রয়েছে আর বাকি?

তবু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় রোজ, কোন মা আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে,
জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি গ্রহণ লেগেছে উজ্জ্বল গোল চাঁদে—
গ্রহণমুক্তি ঘটাবো আমার দেশের, এই প্রতিজ্ঞা করে ফেলি তক্ষুনি:
আমরা মোছাবো মায়ের চোখের জল, মহাকাল হাসে আমাদের কথা শুনি।
সে হাসিতে মিশে যাচ্ছে দেশের ধান, দেশের শিল্প, আর যত হাসিমুখ,
নতুন যুগের নতুন ভোরের কাছে, সূর্যমুখীরা হোক আজ উন্মুখ,
জ্ঞানের পূজারী হোক আজ উন্মুখ…

© শ্রী সৈকত
২২ শে মাঘ, ১৪২৬
বহরমপুর

সর্বাধিক পছন্দের লেখা

পুরুষোত্তমের প্রতি

পুরুষোত্তমের প্রতি                                          ~ সৈকত দাস হে চির সুধীর, কৌশলী বীর, তব বাণী ছায়াতলে, অব...