Tuesday 28 July 2020

মুদ্রা

মুদ্রা



আমার শহরে ভালোবাসার মুদ্রা অচল,
ইট কাঠ পাথরের শহরের বাসিন্দা আমি,
নারী-পুরুষ হাতে-হাত নিরর্থক লাগে
কঠিন বাস্তবতার ধুলো জমে আছে দুই চোখে।
কে যেন আমাকে আমায় দুহাত ছড়িয়ে ডাকে
পাথরে গড়া বুক তার, উষ্ণ লাভা বয় ধমনীতে,
চোখের জায়গায় গভীর দুটো গর্ত—
কেউ যেন কেড়ে নিয়েছে তার দেখার অধিকার!
তার দুই হাতের নানা জায়গা কেটে গিয়ে ঘা হয়ে আছে,
নোংরা পোকা আর মাছি ভনভন করছে সেখানে,
তার বিবস্ত্র দেহটাকে ভোগ করে চলেছে কিছু নারীপুরুষ
আর পাথর-বুক থেকে জীবন খোঁজার 
অকারণ চেষ্টা করে চলেছে একটা মাস ছয়েকের শিশু।
নির্বিকার নিস্পৃহ সে হয়তো ভেবে চলেছে কিছু…

কী ভাবছে?
কাল উন্নত শহরের নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে 
মারা গেছে তার চারটে ছেলে?
নাকি ভাবছে তার শ’খানেক সন্তানের কথা
যারা কালকেই মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়?
নাকি কালকের ষাটজন ধর্ষিতা মেয়ের কথা?
নাকি সেই পরিবারের কথা, যাকে গ্রামের লোকজন
গ্রামছাড়া করেছে, কারণ তার মেয়ে ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিয়ে করেছে?
সে কি মন্দির মসজিদের কথা ভাবছে
আমাদের খবরের চ্যানেলগুলোর মতো?
ভাবার কী আছে এত? 
এ তো রোজ হয়, হচ্ছে আর…

হঠাৎ মুখ খোলে সে, ভয় পেয়ে যায় ধর্ষক নারীপুরুষগুলো,
শিশু যেন পরম আশ্বাসে আঁকড়ে ধরে তার পাথরের বুক,
ধীরে ধীরে তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়,
সকল নির্লজ্জতা, সকল খুনোখুনির প্রতিশোধ নেবার জন্য
যেন তৈরি হয়ে গেছে সে, বাইরে থেকে, ভেতর থেকে!

আগেই বলেছিলাম, আমার চোখে এ দেশ ক্রমশঃ পাথরের হয়ে যাচ্ছে।
হয়তো সে সম্পূর্ণ পাথর হয়ে গেছে এতক্ষণে!
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তার কাছে— স্পর্শ করলাম,
অবাক হলাম, সে ফুলের থেকেও বেশি কোমল!
জিজ্ঞাসা করলাম, “তবে কি এখনও মুক্তির সময় হয়নি মা?”
সে বলল, “এসেছে সেই সময়, দেখ, জেগেছে সন্তানরা আমার!”
“কিন্তু তুমি যে অনেক নরম হয়ে গেছ!”, সরে গেলাম আমি!
“একাজের জন্য তো পাথর হতে হবে, মা!”
সে বলল, “পাথর হলে ভালো বাসতে পারবি তোর মায়ের সন্তানদেরকে?”

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল!
রাত এখন অনেক গভীর,
তবে রাতের একটা পেঁচা কর্কশ শব্দে জানান দিয়ে গেল,
সব দেখছে সে, সব দেখছে তার গোল গোল চোখ দুটো দিয়ে;
আর আমার শহরে নতুন এক মুদ্রা চালু হয়েছে—
ভালোবাসার মুদ্রা!

© শ্রী সৈকত
১২ শ্রাবণ, ১৪২৭

Sunday 26 July 2020

অজ্ঞাত

অজ্ঞাত



কবির কবরের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঁটাগাছ।
এলাকার লোকজন চেনে না সেই কবিকে,
চেনে না সেই গাছটিকেও।
বছর তিনেক আগে একদিন তারা দেখেছিল
একজন মানুষের দেহ, পড়ে আছে তাদের গোরস্থানে,
পাশে পড়ে ছিল একটা অসমাপ্ত কবিতা লেখা কাগজ,
আর কয়েক ফোঁটা রক্ত— কাগজে নাম ছিল না কবির।
বোঝা যাচ্ছিল, ওটা আত্মহত্যা।
জাতের পরিচয় না জানা সত্ত্বেও
তারা সৎকার করেছিল সেই দেহের,
কাগজটা বাক্সে ভরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল পাশেই।

আজ খুব ভোরে অলক মাঝি ঘাটে যাবার সময়,
অবাক হয়ে দেখল সেই কাঁটাগাছে ফুটে আছে
অজানা এক ফুল, কালচে লাল রং তার,
ঠিক যেন কবির রক্তের মতো লাল।
পাশেই খোঁড়া মাটির পাশে পড়ে আছে একটা কাগজ,
এগিয়ে গিয়ে দেখল সে—
অসম্পূর্ণ কবিতাটা সম্পূর্ণ করে গেছে কেউ
শুকনো রক্তের দাগের ওপরে কালো কালি দিয়ে
লিখে গেছে কবিতার বাকি অংশটা:
ফুলটার ওপরে থাকা একফোঁটা রক্ত কি দেখতে পেল সে?—
কবরের ভেতর থেকে সেটা বুঝতে পারলেন না কবি।

© শ্রী সৈকত
১০ শ্রাবণ, ১৪২৭

Tuesday 21 July 2020

উন্মোচন

উন্মোচন

                    ~ শ্রী সৈকত

 

সময় হেঁটে চলে সরীসৃপের মতো, বুকে ভর দিয়ে।
ঠাণ্ডা রক্তের স্রোতের মতো বয়ে চলি আমরা।
অতীতের গর্ভে সুপ্ত থাকে বর্তমানের বীজ,
আর বর্তমান বুনে চলে ভবিষ্যতের জন্য অদৃশ্য সূক্ষ্ম জাল।

ভাগীরথীর পাশে কোনো এক ঘাটে দাঁড়িয়ে হঠাৎ খেয়াল হলো:
এ-নদীর প্রথম জলবিন্দুর খোঁজে যাব—
সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে হিমালয় সৃষ্টির পরই কি
গঙ্গোত্রী তার মেয়ের জন্ম দিয়েছিল?
প্রথম সেই জলের কণা কি আজও খুঁজলে পাওয়া যাবে সমুদ্রের বুকে,
নাকি ঘটে গেছে তার উপাদানের অনেক বিকৃতি?
মানুষের ইতিহাসের মতো হয়তো বিকৃত হয়েছে সে-ও!

চির অস্থির নদীর মতো চিরগতিশীল ভারতের খোঁজে
তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল আমার মন, বুদ্ধি আর চেতনা।
অতীতের ভারত এবার ধরা দেবে আমার কলমে,
সহজতায় আর মাধুর্য্যে সে অতীতের কথা লিখে দেবে,
বর্তমানের গবেষণার হাত ধরে আবরণ উন্মোচিত হবে আমার চেতনার।
সরীসৃপের মতো সময়, একইভাবে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলল…

© শ্রী সৈকত
৫ শ্রাবণ, ১৪২৭
বহরমপুর

Wednesday 8 July 2020

আগন্তুক

আগন্তুক
           ~ শ্রী সৈকত



অনাবশ্যক মেঘ এসে পরিবেশটাকে গরম করে রেখেছে।
সন্ধ্যার আকাশ নাকি একঘেয়ে মেঘে ঢাকা—
কার ভালো লাগে বলুন দেখি!
মেঘ যদি হলই, একটু বৃষ্টি হোক,
গরম মাটি প্রাণপণে শুষে নিতে চেষ্টা করুক শেষ জলবিন্দুটুকু:
না-তো শুধু মেঘ আর মেঘ, আর একটা গুমোট ভাব
ঘিরে ধরছে নাগপাশের মতো, অথচ রঘুকূলের কেউ নই আমি!
হঠাৎ মনে হলো, সন্ধ্যার মেঘের একমাত্র কাজ হচ্ছে
চাঁদ আর তারাগুলোকে দেখতে বাধা দেওয়া,
তাতেই তার স্বর্গসুখ, সে চাঁদ পূর্ণিমার হোক, কিম্বা একাদশীর!
অসময়ের আগন্তুক যখন অক্টোপাসের মতো শুঁড়গুলো দিয়ে
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে আমার নক্ষত্রপ্রেমী বন্ধুকে,
ঠিক তখনই আবিষ্কার করলাম
অত মেঘের মধ্যেও একটি তারা জ্বলজ্বলে চোখে
তাকিয়ে আছে আমার দিকে—
সে আলো হয়তো শতবর্ষ পুরনো,
তবু অর্বাচীন মেঘ এসে ঢেকে দিতে পারেনি তাকে…
বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম: আমরা কি ঐ তারার মতো হতে পারি না?

© শ্রী সৈকত
২৩ আষাঢ়, ১৪২৭

Monday 6 July 2020

স্বামী বিবেকানন্দ ও বিশ্বধর্ম

স্বামী বিবেকানন্দ ও বিশ্বধর্ম
                                        ~ শ্রী সৈকত
  

“ ‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং ।
     নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব ॥’

— বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলে একই সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে দেয়। ঠিক তেমনই রুচির বৈচিত্র্যবশতঃ সরল বা কুটিল (জটিল) নানা পথে যারা চলেছে হে ভগবান তুমি তাদের একমাত্র লক্ষ্য।”

  সুললিত  কন্ঠে বলে চলেছেন গৈরিকবসন পরিহিত, উষ্ণীষধারী এক সন্ন্যাসী। বইছে ভারত-আত্মার অমৃতধারা—

“ ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ ।
   মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থঃ সর্বশঃ ॥’

—যে যেভাবেই আসুক না কেন, আমি তাকে সেই পথেই অনুগ্রহ করে থাকি। হে অর্জুন, মানুষেরা সর্বদা আমাকেই অনুসরণ করে চলেছে।”

  বজ্রনির্ঘোষে ঘোষিত হচ্ছে চিরন্তন ধর্মের বাণী। ভেঙে যাচ্ছে যুগধর্মগুলির বেড়া। এ যেন মুক্তি! চরম মুক্তির আনন্দ আস্বাদন করছে জগৎ!


ধর্ম ও তার উদ্দেশ্য:

  বিশ্বধর্ম ও মানবতার সম্বন্ধে আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে আমাদের জানতে হবে ধর্ম কী। আমাদের মধ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে থাকে যে, ধর্ম মানেই একজন সর্বময় কর্তা থাকবেন, আর সেই ধর্মের অনুসারীরা তাঁর ভজনা করবেন। মৃত্যুর পর স্বর্গ-নরক জাতীয় চিন্তাভাবনাই যেন ধর্ম! ধর্মের সঙ্গে এই বিষয়গুলি গুলিয়ে ফেলা আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে!




  তাহলে ধর্ম কী? ধর্ম হলো সামাজিক স্থিতি রক্ষার জন্য কর্ম। মানুষ যাতে সুখী হয়, তার জন্য সমাজকে তো স্থিতিশীল, উন্নতিশীল হতে হবে। একেই ধর্ম্যম্ বলা হচ্ছে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব স্বতন্ত্র ধর্ম রয়েছে, কিন্তু তারা একে অপরের সাথে এমনভাবে যুক্ত যে, মিলেমিশে একটি অখণ্ড ভাব গঠন করে। নিজ নিজ কর্তব্য পালনের মাধ্যমে মানুষ তার পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্ব আর মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উন্নীত হতে পারে— এটাই সব ধর্মের উদ্দেশ্য। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কর্তব্যের পরিবর্তন হয়। তাহলে কি ধর্মবোধও আলাদা আলাদা হবে?

  প্রতিটি ধর্মেরই কিছু পবিত্রগ্রন্থ থাকে। সেই পবিত্রগ্রন্থগুলির মধ্যে নিহিত অংশগুলিকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়— শ্রুতি ও স্মৃতি। শ্রুতি হলো চিরন্তন সত্যের প্রতিধ্বনি, মুক্তির তোরণ। স্মৃতি অংশে থাকে আইন সম্বন্ধীয় বিষয় আর পুরাণের (Mythological) গল্প। স্মৃতি সাধারণ মানুষের বুদ্ধির কাছাকাছি থাকায় অনেকে এই স্মৃতিকেই ধর্ম বলে মনে করেন। স্মৃতি হলো যুগধর্ম, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে পরিবর্তিত হতে হবে— হতেই হবে! শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়, “বাদশাহী আমলের টাকা (ইস্ট ইন্ডিয়া) কোম্পানির আমলে চলে না।” স্থান-কালের ভেদ থাকায় ধর্মগুলির স্মৃতি অংশ আলাদা আলাদা হয়, আর এখানেই লাগে দ্বন্দ্ব। যাঁরা ধর্ম নিয়ে অত্যন্ত গোঁড়া তাঁরা মূলত এই স্মৃতিকেই ধর্মের সার বলে ভেবে থাকেন। সমস্ত ধর্মের শ্রুতিই এক, সর্বব্যাপী, অবাঙ্মনসগোচর (বাক্য-মনের অগোচর) পরমাত্মার কথা ভিন্ন ভিন্ন যুক্তিতে উপস্থাপিত করেছেন, যা মূলতঃ একই সত্যের ভিন্ন প্রতিধ্বনি। কারণ, সত্য কখনও দুরকম হয় না। ইদানিংকালে অতীতের ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলিকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ প্রতীয়মান হওয়ার কারণ হল, শ্রুতিকে স্মৃতি থেকে বা নিত্য অংশকে অনিত্য অংশ থেকে, ঐতিহ্যগুলির শাশ্বত আধ্যাত্মিক সত্যকে ঐতিহাসিক সামাজিক তথা রাজনৈতিক মতবাদগুলি থেকে আলাদা করতে না পারা; যে তত্ত্বগুলি সময়ের প্রয়োজনে উদ্ভুত এবং বর্তমান সময়ে নিতান্তই অদরকারি অথবা ক্ষতিকর, সেগুলি প্রত্যাখ্যানের অনিচ্ছা; নতুন সময়োপযোগী স্মৃতি যুক্ত না করতে পারা— এই বিষয়গুলিকে উল্লেখ করে গণিতজ্ঞ দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড্ বলেছেন, “ধর্ম  তার পূর্ব গৌরব ফিরে পাবে না যতদিন না তা বিজ্ঞানের মত পরিবর্তিত অবস্থার সম্মুখীন হতে পারছে। এর মূলতত্ত্বগুলি শাশ্বত হতে পারে, কিন্তু তত্ত্বগুলির প্রকাশভঙ্গি নতুন নতুন ভাবে ক্রমান্বয়ে উদ্ভাবিত হওয়া প্রয়োজন।”


পরীক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ:

   দক্ষিণেশ্বরের পাগল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। রানী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণীর মন্দিরে সন্তান ভাবে মাতৃসাধনে নিমগ্ন। কখনো নিজে খেয়ে তারপর মাকে খাওয়ান, কখনো বা মা-মা বলতে বলতে মেঝেতে মাথা কোটেন। অবশেষে মায়ের দেখা পেলেন তিনি। কিন্তু, মা তাঁকে একভাবে বেঁধে রাখলেন না। তিনি যে অধ্যাত্মবিজ্ঞানী! চরৈবেতি, চরৈবেতি! শাক্তমতে সাধনার পর ভৈরবী ব্রাহ্মণীর নির্দেশে তন্ত্রমতে, বৈষ্ণবমতে মধুর ভাবে এবং পরবর্তীতে সাধক তোতাপুরীর কাছে সন্ন্যাসে দীক্ষা নিয়ে অদ্বৈত মতে সাধনা। হিন্দুমতের নানা পথ যাচাই করার পরে সুফী সাধক গোবিন্দ রায়ের কাছে ইসলাম মতে পবিত্র ‘আল্লাহ’ নামের সাধনা করে আর আরও পরে খ্রীষ্টানমতে সাধনা করে যখন তিনি দেখলেন “এক রাম, তাঁর হাজার নাম”, তখন এই মহাজ্ঞানী পরীক্ষক রায় দিলেন— “যত মত, তত পথ”। গীর্জার প্রার্থনাকক্ষকে তিনি ‘কালীঘর’ বলতেন। মৌলবীর অসুস্থতার খবর জানতে পেরে, কাছের মসজিদে সন্ধ্যার নামাজ পড়িয়ে এসেছিলেন এই অবতারবরিষ্ঠ। নানা স্বাদে পরীক্ষা করে, তিনি সার্বজনীন ধর্মমতকে সহজপাচ্য করে রাখলেন ভবিষ্যতের নরঋষির জন্য— বিশ্বসভায় যাঁর আবির্ভাবে শুরু হবে এক নতুন যুগের…



ঠাকুরের নরেন:

   ঠাকুরের সাথে তরুণ নরেন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ। ভালোলাগা আর তারপরেই যাতায়াত। এই সময়ে ঠাকুর তাঁর নরেন কে বেছে বেছে সেই বইটি পড়তে দিতেন, যা অন্যদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ— অষ্টাবক্র সংহিতা। নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন বলে নির্গুণ নিরাকার অদ্বৈত ব্রহ্মকে মন থেকে মানতে পারেননি। ব্রাহ্মসমাজে সগুণ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা হতো। নরেন্দ্র বলেছিলেন, ও বই যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই পাগল! ‘আমি ঈশ্বর’ এ কথা ভাবা পাপ! সবাই ঈশ্বর! এ কেমন কথা! কিন্তু, ধ্যানসিদ্ধ নরেনের চিন্তাধারা আমূলে পরিবর্তিত হয়ে গেল প্রেমের ঠাকুরের আশীর্বাদে। বিশ্বজগৎ অন্তর্হিত হল! সব এক বলে প্রতিভাত হতে লাগল তাঁর কাছে! সর্বত্র ঈশ্বরদর্শন করতে লাগলেন ঠাকুরের নরেন! এক ঈশ্বর নানারূপে প্রতিভাত হচ্ছেন। ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই নেই!

  আদি জগদ্গুরু আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, “ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ॥” অর্থাৎ, ঈশ্বর একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা। জীব স্বরূপত ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই নয়! ঈশ্বর এক, অদ্বিতীয়। তিনি কখনোই ‘অনেক’ হননি। আমরা মায়ার প্রভাবেই এই জগৎসংসার দেখছি! অপরোক্ষঅনুভূতির দ্বারা নিজের স্বরূপকে উপলব্ধি করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।

  গুরু-শিষ্যের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ঠাকুর ধীরে ধীরে নরেনকে তাঁর সকল আধ্যাত্মিক সম্পদ দান করলেন। একদিন অর্ধবাহ্যদশায় ঠাকুরের শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হল— জীবে দয়া! জীবে দয়া করবার তুই কে? কীটানুকীট তুই জীবকে দয়া করবি? সেবা! সেবা! শিবজ্ঞানে জীবের সেবা!

  সেদিন নরেন্দ্র প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সময় পেলে এই কথা তিনি বিশ্বকে শোনাবেন। এ যে ধর্ম, জাত, দেশ দেখে সেবা নয়— এ যে মানবপ্রেম! এ যে বিশ্বপ্রেম! সেদিনকার নরেন, পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ, এই ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে অত্যন্ত সাহসী ভাষায় লিখেছিলেন,
“ব্রহ্ম হ’তে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
  মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
  বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
  জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”


বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন ও তার উদ্দেশ্য:

  ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দ। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশ’ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত হয়েছে এক বিরাট মেলা— আমেরিকার শিকাগো শহরে। তার আয়োজক চার্লস বনি সাহেব প্রদর্শনীর পাশাপাশি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনাচক্রের ব্যবস্থাও করেছেন। সাহিত্য, দর্শন, সঙ্গীত, শিল্প, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে আলোচনাও যোগ করেন তিনি— আর এখানেই বাঁধে গোলমাল। শুধু খ্রীষ্টানদের নিয়ে সম্মেলন হলে কোনো অসুবিধেই নেই। কিন্তু, একই মঞ্চে অন্য ধর্মের লোক কিছুতেই থাকতে পারেননা— এ প্রভু যীশুর অপমান! অবশেষে ধর্মমহাসভা বহাল থাকলো। বাইরের থেকে তার উদ্দেশ্য হল ধর্মসমন্বয় আর ভেতরের দিকে মুখ্য উদ্দেশ্যটি থাকলো নিহিত— অন্যান্য ধর্মের সামনে খ্রীষ্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা।

  কিন্তু, সকল গোপন উদ্দেশ্যে জল ঢেলে দিলেন পরাধীন ভারত থেকে আগত এক নবীন সন্ন্যাসী!



কলম্বাস হলে…

  “শিকাগো সঙ্ঘে সঙ্গীত তব শীর্ষে উঠিল ভাসি,
   শুনিল বিশ্ব, শুনিল নিঃস্ব, শুনিল প্রাসাদবাসী;”

  বীণাপাণির চরণে মনপ্রাণ অর্পণ করে তরুণ বীর সন্ন্যাসী উঠলেন মঞ্চে। বহুকাল ধরে তিনি আধ্যাত্মিকতা আর ব্রহ্মচর্যের বারুদ তাঁর অন্তরে ঠেসে ঠেসে ভরেছেন। দরকার ছিল একটি যোগ্য মঞ্চের। আজ এই ‘ধর্মক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ’দের দেখে তিনি ‘বোমার মতো ফেটে’ পড়লেন! নিক্ষেপ করলেন তাঁর অগ্নিবান। বললেন, “সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব্ আমেরিকা”! সবাই তাঁর ভাই-বোন! এরপর বললেন আরও চমৎকার কথা— তিনি ধন্যবাদ জানালেন পৃথিবীর প্রাচীনতম সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। যে সন্ন্যাসের নাম শুনলে পাশ্চাত্যবাসী তো দূরের কথা ভারতীয়রাও মানসিক, শারীরিক বিকারগ্রস্ত বলতে দ্বিধা করেন না। তিনি সেই দীনের দীন, কপর্দকহীন সন্ন্যাসী! তাই তিনি গর্বিত। এরপর তিনি বললেন, ‘সকল ধর্মের জননীর’ পক্ষ থেকে তিনি ধন্যবাদ জানাচ্ছেন! মা যেমন বিপদে-আপদে তাঁর সন্তানদের আঁচল দিয়ে আগলে রাখেন, ঠিক তেমনই ‘ভারতবর্ষের ধর্ম’ সর্বদা পরমতসহিষ্ণুতা এবং পরমতগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। কত বিভিন্ন জাতি এসে একীভূত হয়ে গেছে ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘ঘনীভূত ভারতবর্ষ’ বলে চলেছেন— তিনি সেই ধর্মের প্রতিনিধি, যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ‘এক্সক্লুশন’ শব্দটিকে অনুবাদ করা যায় না। বাদ দেওয়া বা বহিষ্করণ নয়, আলিঙ্গনাবদ্ধ করাই যার লক্ষ্য। তিনি সম্মেলনের শুরুর ঘণ্টাধ্বনিতেই যেন শুনতে পেলেন ধর্মের নামে সকল হানাহানির মৃত্যুঘণ্টা! পৌত্তলিক ধর্ম, নিরাকারে বিশ্বাসী ধর্ম, অবিশ্বাসী নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, শূন্যবাদী— সব যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে তাঁর সম্মুখে— সেই ধারার ভগীরথ তিনিই।


মতভেদের কারণ:

“আলীর উপর কালী, না কালীর উপর আলী!
বল খোদা বল খোদা বল।...”

  সকল ধর্মই যদি একই সত্যের উদ্দেশে ধাবমান হয়, তবে এত মতভেদ কেন? আসলে ছাদে ওঠার নানা পন্থা আছে— সিড়ি, বাঁশের মই, বা দড়ির মই। কিন্তু শুধু কি তাই? এই প্রসঙ্গে স্বামীজী একটি সুন্দর গল্প বললেন— এক কুয়োতে একটি ব্যাঙ থাকতো। সেই কুয়োর বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। একদিন এক সমুদ্রের ব্যাঙ সেই কুয়োতে এসে পড়ে। অতঃপর সেই কূপমন্ডুক তার কুয়োর সাথে সমুদ্রের পরিধির তুলনা করতে লাগে! সমুদ্রের ব্যাঙ তাকে সত্য বোঝাতে চাইলেও সে নিজের মতে অনড় থাকে— তার কুয়োর থেকে বড় আর কিছুই হতে পারে না। অবশেষে, কুয়োর ব্যাঙটি, সমুদ্রের ব্যাঙটিকে তাড়িয়ে দেয়। আমরা যেন কূপমন্ডুকের মতো! হিন্দু তার কুয়োয় বসে ভাবছেন ‘এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ’, মুসলমান, খ্রীষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ, ইহুদী, পারসিক— সব্বাই তাই ভাবছেন! একে অন্যের ভাব নিতেই চান না! এ যেন চোখে কালো কাপড় বেঁধে ‘অন্ধকার, অন্ধকার’ বলে আর্তনাদ করা। তাইতো তিনি বললেন, চার্চে জন্মানো ভালো, কিন্তু চার্চে মৃত্যু ভালো না! গোঁড়ামিকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বারংবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন যেন তিনি কখনো গোঁড়া না হয়ে যান। বাইরের আলো-বাতাস আসার জন্য জানলা খুলে দাও। বাইরের অনন্ত জগৎ— এক অখণ্ড সত্ত্বা!


বিশ্বভ্রাতৃত্ব:

  “ॐ সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ। সর্বে সন্তু নিরাময়ঃ।
   সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু। মা কশ্চিদ্দুঃখভাগ্ভবেৎ। ॐ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥”

— সকলে সুখী হোক, সকলের রোগ নিরাময় হোক, সকলে পবিত্র দৃশ্য দেখুক, কেউ যেন দুঃখের ভাগী না হন। সকলে ত্রিবিধ শান্তি লাভ করুক।

  এই ভাবের প্রতিনিধি তখন কলম্বাস হলের মঞ্চে। উদাত্ত কণ্ঠে আমেরিকাবাসীদের সঙ্গে পাতালেন ভাই-বোনের সম্পর্ক। কিন্তু কেন এই ভাই-বোন? যিনি ‘স্বাহা’ মন্ত্রে সকল মায়িক সম্পর্ক অগ্নিতে আহুতি দিয়েছেন, তিনি, সেই সচ্চিদানন্দ-বিবিদিষানন্দ-বিবেকানন্দ কেন জড়াচ্ছেন বন্ধনে?



  প্রথমত, স্বামীজি ছিলেন বিশ্বমানব। তাই তাঁর সম্পর্ক বিশ্বের সকল মানুষের সঙ্গে। তাঁর নিজের ভাষায়, “যদি আমি শ্বেতকায় আর্য পূর্বপুরুষদের নিকট কৃতজ্ঞ থাকি, তবে আমার পীতকায় মঙ্গোলীয় পূর্বপুরুষদের কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ, আর সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ কৃষ্ণকায় কাফ্রিজাতির কাছে।”

  দ্বিতীয়ত, তিনি একাত্ম অনুভব করছেন। তাঁর কাছে সবাই সেই মহাকালের সন্তান। তাঁর সম্পর্ক রক্তমাংসের নয়— আত্মার! রক্তমাংসের সম্পর্কে জোয়ার-ভাটা আছে; কিন্তু আত্মিক সম্পর্ক অটল, চিরন্তন।

  ভা- জ্যোতি, রত- মগ্ন। সেই জ্যোতিতে মগ্ন দেশ থেকে তিনি এসে বললেন— “তোমরা পাপী? মানুষকে পাপী বলাই এক মহাপাপ। মানবের যথার্থ স্বরূপের উপর ইহা মিথ্যা কলঙ্কারোপ।”১০ খ্রীষ্টান অধ্যুষিত যে দেশের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ‘পাপ’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সে দেশের মানুষ যেন অপার বিষ্ময়ে ভারতবর্ষের এক খনিশ্রমিকের তুলে আনা খাঁটি মনিমুক্তা দেখছেন! সেই মহাশ্রমিকের উদাত্ত কণ্ঠে যেন ধ্বনিত হলো ভারতবর্ষের চিরন্তন বাণী—
‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থুঃ।’১১

  কি মধুর সম্বোধন! অমৃতের (ঈশ্বরের) সন্তান! কেউ পাপী নয়! অন্ধকার কখনোই আলো হতে পারে না। বরং, কম আলো থেকে বেশি আলোতে যাওয়া যায়।

  এভাবেই তিনি মেলাচ্ছেন সকল ধর্মের সম্পদকে একস্থানে। সেই অমৃতে পৌঁছোনোর সিঁড়ি তৈরির উপাদান বানাচ্ছেন। তিনি যে ‘চাপরাশ’ প্রাপ্ত! সকল ভেদাভেদ মেটাতেই হবে তাঁকে!


এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ:

  পাশ্চাত্যবাসীদের মাঝে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির বিজয়পতাকা সদর্পে উড়িয়ে দেশে ফেরার সময় স্বামীজী বললেন, “এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ”। প্রশ্ন ওঠে দুটি— এক, স্বামীজী ভারতের আগে বিদেশে কেন প্রচার করলেন? দুই, ভারতবর্ষকেই ‘কেন্দ্র’ হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ কী?

  পদার্থবিদ্যার নীতি অনুসারে, কোনো সিস্টেমের মধ্যে থাকা কোনো ব্যক্তি, ওই সিস্টেমকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সরাতে বা কোনরকম অবস্থা পরিবর্তন করতে পারেন না। আপনি একটি চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে, সেই চেয়ারটির ওপর যেভাবেই বল প্রয়োগ করুন না কেন, তাকে তুলতে বা সরাতে পারবেন না— বেশি চেষ্টা করলে চেয়ারশুদ্ধ উল্টে পড়বেন! অথচ, চেয়ারের নীচে মেঝেতে পা রেখে, বা চেয়ার থেকে নেমে, ওটিকে ওঠাতে বা সরাতে পারেন, নিশ্চয়ই পারেন। স্বামী বিবেকানন্দ, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে বাংলা পরিভ্রমণ করে ভারতবর্ষের যে সংজ্ঞা খুঁজে পেয়েছিলেন, সেই পরাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে ক্ষুধিত, নিষ্পেষিত ভারতবাসীর সামনে সেই অব্যক্ত কথাকে সম্পূর্ণভাবে বললে, শোনার লোক থাকতো না। তাই তিনি বাইরে একটি বিশ্বমঞ্চ থেকে সমস্ত পৃথিবীর সাথে তাঁর দেশকেও এক অসম্ভব কঠিন আঘাত করে নাড়িয়ে দিলেন— নিদ্রিত ভারতবর্ষ যেন শতাব্দীপ্রাচীন ঘুম ত্যাগ করে জেগে উঠল— এবং পাশ ফিরে শুল!



  ভারতবর্ষের চিরন্তন বাণী ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’— বিশ্বের সকলেই আমার আত্মীয়। তাই ভারতবর্ষই বিশ্বভ্রাতৃত্বের কেন্দ্রভূমি। পৃথিবীর অনেক ধর্মই পরমত সহিষ্ণুতার কথা বলেন, কিন্তু একমাত্র ভারতবর্ষ, অতি প্রাচীনকাল থেকেই হাতেকলমে এই ভাব প্রদর্শন করেছেন। অন্যদিকে ফরাসী মনীষী রম্যাঁ রল্যাঁ (Romain Rolland) যখন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ব্যক্তিত্ব চিরনমস্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘ভারতবর্ষ’ সম্বন্ধে জানতে চাইলেন, কবিগুরু তখন একটিমাত্র বাক্যে বলেন, “যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও, তবে বিবেকানন্দকে জানো; তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক নেই।” আমরা প্রত্যেকে কীভাবে যুক্ত, সেই অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা দিয়েছেন পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ, আর সেই পুণ্যক্ষেত্রের ঘনীভূত রূপ যিনি, তিনি এই একাত্মতার ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বের অগণিত নরনারীর সামনে! তাই আমরা বলব, “এবার কেন্দ্র বিবেকানন্দ”। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তাঁর গানে এই বীর সন্ন্যাসীর উদ্দেশে বললেন,
“ ভারতে আনিলে তুমি নববেদ
  মুছে দিলে জাতি ধর্মের ভেদ।
  জীবে ঈশ্বরে অভেদ আত্মা, জানাইলে উচ্চারি…”

  এশিয়া, বিশেষত ভারতবর্ষ, যেন একটি উন্নতমানের বিমানবন্দর, উচ্চমানের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা এখানেই জন্ম নেন, কর্ম করেন! আশ্চর্যের বিষয় নয় কি? আজকে বিশ্বের জ্ঞানী ব্যক্তিরা, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মনকে কেন্দ্রীভূত (focus) করার জন্য ধ্যানকে অপরিহার্য বলছেন, শিল্পের মাধ্যমে সমাধিমগ্ন হয়ে যাবার কথা বলছেন, তখন কি মনে হয় না সত্যিই তো, “এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ!” ভারতবর্ষ কখনোই কোনো বিদেশী দেশকে আক্রমণ করেনি, লুটতরাজ করেনি, ভারতবর্ষ কৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, কবীর, রামকৃষ্ণ, সুফী-বাউল সাধকদের দেশ! এই দেশ শেখায় “মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্”১২— অন্যের সম্পদে লোভ করো না! শেখায় মানবতার বাণী, জানায় সহিষ্ণুতার বার্তা!


অদ্বৈতের ঘর:

  সাধনার সময় শ্রীরামকৃষ্ণের মাথার চুল বড়ো হয়ে জটার আকার নিয়েছিল। সেই পাগল বামুন, নিজের ব্রাহ্মণত্বের অহংকার (যদি কিছু থেকে থাকে) চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্য তাঁর জটা দিয়ে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের পার্শ্ববর্তী রসিক মেথরের বাড়ির নর্দমা পরিষ্কার করেছিলেন। মাথার ওপর ঝুড়িতে করে মল বয়ে নিয়ে গিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করেছিলেন এই যুগাবতার। তাঁর শিষ্যও তেমনি মেথরের হাতে বানানো, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা মেশানো রুটি খেয়েছিলেন পরিতৃপ্ত হয়ে। মুসলমান ভদ্রলোকের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তত্ত্ব নয়, তাঁর প্রয়োগও করে দেখিয়েছিলেন এই দুই সন্ন্যাসীপ্রবর। ধর্মের (স্মৃতি থেকে সৃষ্ট) নামে মানুষদেরকে উচ্চ-নীচে বিভক্ত করার নিকৃষ্ট প্রয়াসকে লক্ষ্য করে স্বামীজী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় লিখছেন, “আর্য বাবাগণের জাঁকই কর, প্রাচীন গৌরব ঘোষণা দিনরাতই কর; আর যতই কেন তোমরা ‘ডম্‌ম্‌ম্‌’ বলে ডম্ফই কর, তোমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছ? তোমরা হচ্চ দশ হাজার বছরের মমি!! যাদের ‘চলমান শ্মশান’ বলে তোমাদের পূর্বপুরুষেরা ঘৃণা করেছেন, ভারতে যা কিছু বর্তমান জীবন আছে, তা তাদেরই মধ্যে। আর 'চলমান শ্মশান' হচ্চ তোমরা। তোমাদের বাড়ি-ঘর-দুয়ার মিউজিয়ম, তোমাদের আচার-ব্যবহার, চালচলন দেখলে বোধ হয়, যেন ঠানদিদির মুখে গল্প শুনছি! তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ করেও ঘরে এসে মনে হয়, যেন চিত্রশালিকায় ছবি দেখে এলুম। এ মায়ার সংসারের আসল প্রহেলিকা, আসল মরু-মরীচিকা তোমরা— ভারতের উচ্চবর্ণেরা! তোমরা ভূত কাল—লুঙ্ লঙ্ লিট্ সব এক সঙ্গে। বর্তমানকালে তোমাদের দেখছি বলে যে বোধ হচ্চে, ওটা অজীর্ণতাজনিত দুঃস্বপ্ন। ভবিষ্যতের তোমরা শূন্য, তোমরা ইৎ-লোপ লুপ্। স্বর্গরাজ্যের লোক তোমরা, আর দেরি করছ কেন? ভূত-ভারত-শরীরের রক্তমাংসহীন-কঙ্কালকুল তোমরা, কেন শীঘ্র শীঘ্র ধূলিতে পরিণত হয়ে বায়ুতে মিশে যাচ্চ না?…নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে। এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে; নীরবে সয়েছে—তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করেছে—তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারবে; আধখানা রুটি পেলে ত্রৈলোক্যে এদের তেজ ধরবে না; এরা রক্তবীজের প্রাণসম্পন্ন। আর পেয়েছে অদ্ভুত সদাচারবল, যা ত্রৈলোক্যে নাই। এত শান্তি, এত প্রীতি, এত ভালবাসা, এত মুখটি চুপ করে দিনরাত খাটা এবং কার্যকালে সিংহের বিক্রম!! অতীতের কঙ্কালচয়! এই সামনে তোমার উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ ভারত! ঐ তোমার রত্নপেটিকা, তোমার মানিকের আংটি—ফেলে দাও এদের মধ্যে, যত শীঘ্র পার ফেলে দাও, আর তুমি যাও হাওয়ায় বিলীন হয়ে, অদৃশ্য হয়ে যাও, কেবল কান খাড়া রেখো; তোমার যাই বিলীন হওয়া, অমনি শুনবে কোটি-জীমূতস্যন্দী ত্রৈলোক্যকম্পনকারী ভবিষ্যৎ ভারতের উদ্বোধন-ধ্বনি—‘ওয়াহ্ গুরু কি ফতে’।”১৩

  শরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) যেমন মায়ের ছেলে, ডাকাত আমজাদও তেমনই মায়ের ছেলে— দুজনেই শ্রীশ্রীমার পরম স্নেহের পাত্র ছিলেন। ঈশ্বর যখন মানবরূপ ধরে আসেন, তখন তাঁরা তাঁদের কথা আর কাজের মাধ্যমে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যান, আমাদের কী করা উচিৎ, কী নয়।



  অদ্বৈতবেদান্ত নিঃসন্দেহে ঘোষণা করেন, ঈশ্বর এক, তিনিই সব। তিনিই সত্য। এই প্রতীয়মান জগৎ, মায়ার প্রভাবে দৃষ্ট হচ্ছে— ঈশ্বর দ্রষ্টা। একটি ঘটের মধ্যে থাকা আকাশ (space), বাইরের আকাশের থেকে পৃথক বলে মনে হলেও, ঘট ভাঙলে তাদের পৃথক করা যায় না, কারণ তারা কখনো পৃথক হয়ই নি! তেমনই মায়ারূপ ঘট অপসৃত হলে, আত্মার ওপর থাকা সমস্ত উপাধি (দেহ, নাম, মান, যশ, মন, বুদ্ধি ইত্যাদি), জ্ঞানখড়্গে ছিন্ন করলে ‘ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই নেই’— এই পরমজ্ঞান লাভ হয়। অন্ধকারে সামান্য দড়িকে দেখে ভীরু ব্যক্তি সাপ ভেবে অজ্ঞান হয়ে যেতেই পারেন! তাই বলে কি ওই দড়িটি কখনো সাপ হয়েছিল?১৪ কখনো কি ওর মধ্যে বিষদাঁত বা বিষথলি এসে পড়েছিল? না তো! ঠিক তেমনই, সর্বত্র কেবল ঈশ্বরই রয়েছেন, মায়ার ফলে প্রতিভাত রূপগুলির প্রকৃত অস্তিত্ব নেই! যেহেতু, আমরা অখণ্ড, তাই আমাদের মধ্যে কোনো ভেদই নেই। তাই আমরা পরস্পরকে ভালবাসব। অন্যের সেবার জন্য সর্বদা তৎপর থাকব। মহাকাশ অনন্ত, তার কোনো রং নেই, আলোর বিচ্ছুরণের কারণেই আমরা আকাশকে নীল দেখি— এইসব জানার পরেও কি আমরা নীল আকাশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করব না? ঠাকুর তো বলেই গেছেন, “অদ্বৈত জ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা ইচ্ছা তাই কর”।


বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়:

  “মানুষ চাই! মানুষ! পশু নয়!” ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে স্বামীজী বলছেন, ধর্ম হল একটি ভাব, যা মানুষকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে, আর মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উন্নীত করে। স্বামীজী মানুষকে ডাক দিচ্ছেন— এসো, সকল ক্লীবতা পরিত্যাগ করে মানুষের জন্য খাটতে খাটতে মরে যাও! এটাই ধর্ম। মানুষকে সেবা করাই হলো ঈশ্বরের সেবা। “দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ের সম্বল।”

  তিনি বলছেন তোমরা অজ্ঞানবশতঃ যাদের ‘মানুষ’ বলে ভাবো, আমি তাদের ‘ঈশ্বর’ জ্ঞানে পূজা করি! অদ্বৈতের ঘরের অধিপতি স্বামী বিবেকানন্দ এসে দেখিয়ে গেলেন ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ কর্মসম্পাদন। সকল ধর্ম যেন অভিসারী রশ্মিগুচ্ছের মতো একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে— তিনি চিদানন্দঘনস্বরূপ ঈশ্বর! শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী তো তাই বলেছেন, “কেউ পর নয় মা, জগত তোমার।” দূরে ঠেলে দেওয়া ধর্ম নয়, আলিঙ্গনে আবদ্ধ করাই ধর্ম।



  আদি জগদ্গুরু আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। রামানুজাচার্য্য বলছেন, জগত হলো ব্রহ্মের অংশ। আবার মধ্বাচার্য্য বলছেন, ব্রহ্ম এবং জগৎ, উভয়েই পৃথক পৃথকভাবে অবস্থিত এবং সত্য। স্বামীজী এই সকল মতের সম্মেলনে বললেন, বহু এবং এক প্রকৃতপক্ষে একই মন কর্তৃক দৃষ্ট একই সত্য, যা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন বলে মনে হয়। প্রভু বুদ্ধ এবং প্রভু যীশুর মতো তিনিও বলে উঠেছিলেন, আমি ভাঙতে আসিনি— গড়তে এসেছি। অন্যকে ছোট দেখাতে তিনি আসেননি, সকলকে একসূত্রে গাঁথতে তিনি এসেছেন। সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন মানুষকে রিপুজয়ী হতে হবে— তবেই সে যথার্থ ধার্মিক। ধর্ম অন্ধের মত বিশ্বাসের বিষয় নয়, ভয়ের বিষয় নয়, ধর্ম অনুভবের বিষয়— সেই অনুভবেই সাধক সমাধিমগ্ন হয়ে বলে ওঠেন: ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি’ কিম্বা ‘তত্ত্বমসি’১৫ অথবা ‘অন-অল হক’!১৬ উপনিষদ্ কখনো ভয় দেখান না, উপনিষদ্ বলেন শক্তিমান হতে এবং সত্যকে উপলব্ধি করতে। উপনিষদ বারম্বার বলেন ‘অভীঃ’— নির্ভীক হও! ভীরুতা আর মৃত জীবের জড়তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! স্বামীজী এই উপনিষদের মূর্ত বিগ্রহ। তাই তিনি বললেন, ধ্যানের সময় ‘সিংহের হৃদয়টা বেছে নাও’!!!


প্র্যাক্টিক্যাল বেদান্ত:

  “ধর্মের যা কিছু সব বেদান্তের মধ্যেই আছে, অর্থাৎ বেদান্তদর্শনের দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত— এই তিনটি স্তরে আছে, একটির পর একটি এসে থাকে। এই তিনটি মানবের আধ্যাত্মিক উন্নতির তিনটি ভূমিকা। এদের প্রত্যেকটিরই প্রয়োজন আছে। এই হল ধর্মের সার কথা। ভারতের বিভিন্ন জাতির আচার-ব্যবহার মত ও বিশ্বাসের প্রয়োগের ফলে বেদান্ত যে রূপ নিয়েছে, সেইটি হচ্ছে হিন্দুধর্ম; এর প্রথম স্তর অর্থাৎ দ্বৈতবাদ— ইওরোপীয় জাতিগুলির ভাবের ভেতর দিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে খ্রীষ্টধর্ম, আর সেমেটিক জাতিদের ভেতর হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলমান ধর্ম; অদ্বৈতবাদ উহার যোগানুভূতির আকারে হয়ে দাঁড়িয়েছে বৌদ্ধধর্ম প্রভৃতি। এখন ‘ধর্ম’ বলতে বুঝায় বেদান্ত। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন প্রয়োজন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং অন্যান্য অবস্থা অনুসারে তার প্রয়োগ অবশ্যই বিভিন্ন হবে। তোমরা দেখতে পাবে যে, মূল দার্শনিক তত্ত্ব যদিও এক, তবু শাক্ত শৈব প্রভৃতি প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম ও অনুষ্ঠান-পদ্ধতির ভেতর তাকে রূপায়িত করে নিয়েছে।”১৭  স্বামীজীর মতে, বাস্তবিকতাহীন তত্ত্বের কোনো মূল্যই নেই। ধর্ম হিসেবে বেদান্ত প্রচন্ডভাবে বাস্তবমুখী। ধর্ম আর ব্যবহারিক জীবনের মধ্যে আমরা যে কাল্পনিক বিভেদরেখা টেনে দিয়েছি, তার বিলোপ করতেই হবে। বেদান্তের দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবে প্রয়োগের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হল, মানুষকে স্বয়ং ঈশ্বরজ্ঞানে সেবা করা, মানবাত্মাকে বারম্বার প্রণাম করা। সমস্ত জীবেই ঈশ্বর অধিষ্ঠিত থাকলেও মানবদেহই সেই ঈশ্বরের সর্বোত্তম মন্দির, স্বামীজীর ভাষায় “সকল মন্দিরের তাজমহল।”১৮ যে মুহূর্তে আমি মানবমন্দিরের মধ্যে ঈশ্বরকে দর্শন করে নতমস্তক হবো, সেই মুহূর্তেই আমার সকল পার্থিব বন্ধন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে সেই ভাব আমায় মুক্ত করে দেবে— এটিই নববেদান্ত কিম্বা স্বামীজীর ভাষায় ‘প্র্যাক্টিক্যাল বেদান্ত’।



এবং আজ…

  আজ ধর্মের নামে মানুষ, মানুষের গলা কাটছে; কেউ বা ঈশ্বর, আল্লাহ্, গডের মধ্যে লাগিয়ে দিচ্ছে লড়াই! এইসব মগজহীন বিকৃতমনস্ক মানুষের মাথায় ঢোকেনা স্বামীজীর বারতা! তারা শুনতে পায় না— “আমাদের মাতৃভূমির জন্য ইসলামিক দেহ এবং বৈদান্তিক মস্তিষ্ক প্রয়োজন।” আজও তারা নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণেই ব্যস্ত! কবি নজরুলের বজ্রকঠিন ভাষায়: “উড়ছে আজো ধর্ম-ধ্বজা টিকির গিঁঠে দাড়ির ঝোপে!”

  যে ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকাবাসীদের ‘বোন ও ভাই’ বলে সম্বোধন করেছিলেন যুগনায়ক বিবেকানন্দ, ২০০১ সালের সেই দিনেই বিশ্ব-ইতিহাসের এক কলঙ্কিত ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখে বিভ্রান্ত মানুষ, ধর্মকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করছেন! স্বামীজী পাশ্চাত্যের অতিরিক্ত ভোগবাদী জগৎ দেখে, তাঁর দেশে ফেরার আগে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে এই ভোগবাদের থেকেই সৃষ্টি হবে এক বিশাল মহাযুদ্ধ, আর তারপরেও যদি মানুষ না শুধরোয়, তবে আরো বড়ো যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে পৃথিবীকে! আমরা পরপর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি— শিক্ষা নিয়েছি কি? আচারসর্বস্ব ধর্ম থেকে বেরিয়ে, আমার অত্যন্ত আপন যাঁরা, সেই মানুষের জন্য, সেই পরিবেশের জন্য কিছু করেছি কি?

  যে বিজ্ঞানের উৎপত্তি মানুষের কল্যাণের জন্য, তাকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করছি আমরাই। পরধন লুণ্ঠন, শোষণ, নির্যাতন করছি আমরাই। ধর্মের মিথ্যা দোহাই দিয়ে এখনও মানুষকে বঞ্চনা করছি আমরাই— এই মানুষেরা। প্রযুক্তিবিদ্যার হাতের খেলার পুতুল হয়ে গেছি আমরা। আধুনিক যুগের শিশুমন, কিশোরমন, এমনকি প্রৌঢ়মন ডুবে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়— সামাজিক মাধ্যম, যা আমাদের সমাজবিমুখ করছে! আমাদের সুখ-দুঃখ, পাওয়া - না পাওয়া, সব ‘ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণ’ করছে এইসব technology। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতি মুহূর্তের খবর চুরি করে সারাক্ষন আমাদেরকে এক ‘মিথ্যা জগৎ’-এ ব্যস্ত রাখছে প্রযুক্তির এই সাগরেদরা। প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত করছে মানুষ, নিজেদের ক্ষুদ্র ভোগবিলাসের জন্য। আসলে পৃথিবীতে মানুষই হয় তো একমাত্র জীব, যারা ভাবে, তাদের জীবনধারণের জন্য অন্য কাউকে প্রয়োজন নেই!

  তবু আশা আছে। স্বামীজী বলছেন, একটি দেয়াল কখনও মিথ্যা বলতে পারে না, কিন্তু সেটা দেওয়ালই থাকে, তার কোনো উন্নতি হয় না। কিন্তু, একটি মানুষ, যে মিথ্যা বলে, সে আত্মসংশোধনের মাধ্যমে একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেন— দস্যু রত্নাকরের মতো। যে লিখতে ভুল করে, রাবার (Eraser) তার জন্য নয়; রাবার তার জন্য, যে তার ভুল লেখাকে সংশোধন করতে চায়। সেই জ্ঞানরূপ রাবার আমরা অর্জন করব, এটাই আমাদের লক্ষ্য। প্রচুর পরিমাণে উৎকৃষ্ট বই পড়ুন, ইন্টারনেট থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকুন আর অর্জিত জ্ঞান দিয়ে মানুষের সেবা করুন।



  যিনি আপনের চাইতেও আপন, যিনি আমার প্রকৃত স্বরূপ, সেই সচ্চিদানন্দ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, “ আজকে প্রাণের গো-ভাগাড়ে” যে সব “চিল শকুনি” উড়ছে, পবিত্র জ্ঞান সাবানে তাদের গোঁড়ামি দূর হোক! আমরা সকলে তাঁর কাছে, নিজের ‘আমি’র কাছে প্রতিজ্ঞা করি, সূর্যমুখী ফুল যেমন সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, আমরাও সর্বদা জ্ঞানের দিকে উন্মুখ হয়ে থাকব। নিজের মধ্যে ক্ষুদ্র অহং, দুর্বলতা, মোহকে কখনোই প্রশ্রয় দেবো না। নিজেকে আবিষ্কার করব— এটাই ধর্মের উদ্দেশ্য। সকল মত, সকল পথের প্রতি আমার হৃদয়দ্বার উন্মুক্ত রাখব। ভারতবর্ষের ‘মেরুদন্ড’ হল ‘ধর্ম’। তাই ব্রিটিশ শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল, এই ধর্মীয় শিক্ষাকে ধুলিস্যাৎ করা। আমরা, স্বাধীন  ভারতের মানুষেরা, নিজের দেশের মেরুদণ্ডকে আর ভাঙতে দেবো না। নিজে ধর্মকে জানব, চিনব— পরবর্তী প্রজন্মকে জানাব, চেনাব।

  শিকাগোর বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের সপ্তদশ অর্থাৎ অন্তিম দিনে, বিদায় সম্ভাষণের সময় প্রাণসখা বিবেকানন্দ কী বলেছিলেন জানেন? মেঘমন্দ্রিত স্বরে উচ্চারিত হয়েছিল, “যদি এখানে কেহ এরূপ আশা করেন যে, প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে একটির অভ্যুদয় ও অপরগুলির বিনাশ দ্বারা এই ঐক্য সাধিত হইবে, তাহাকে আমি বলি, ‘ভাই, এ তোমার দুরাশা।’ আমি কি ইচ্ছা করি যে খ্রীষ্টান হিন্দু হয়?— ঈশ্বর তাহা না করুন। আমার কি ইচ্ছা যে, কোন হিন্দু বা বৌদ্ধ খ্রীষ্টান হউক?— ভগবান্ তাহা না করুন।… যদি কেহ এরূপ স্বপ্ন দেখেন যে অন্যান্য ধর্ম লোপ পাইবে এবং তাঁহার ধর্মই টিকিয়া থাকিবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র; তাঁহার জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত, তাঁহাকে আমি স্পষ্টভাবে বলিয়া দিতেছি, তাঁহার ন্যায় ব্যক্তির বাধাপ্রদান সত্ত্বেও শীঘ্রই প্রত্যেক ধর্মের পতাকার উপর লিখিত হইবে: ‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।”১৯

ॐ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ
শ্রীরামকৃষ্ণার্পণমস্তু


তথ্যসূত্র:

১. শিবমহিম্নঃ স্তোত্রম্, সপ্তম শ্লোক

২. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (পরবর্তীতে ‘বাণী ও রচনা’), প্রথম খণ্ড, পৃ: ৬, চতুর্দশ পুনর্মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা

৩. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, চতুর্থ অধ্যায়, একাদশতম শ্লোক

৪. উপনিষদের সন্দেশ, স্বামী রঙ্গনাথানন্দ, পৃ: ৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা

৫. Science in Modern World, Alfred North Whitehead, P- 238, Cambridge University Press

৬. সখার প্রতি, স্বামী বিবেকানন্দ

৭. স্বদেশ বিদেশ উছলি উঠিছে, স্বামী অভেদানন্দ

৮. জলের উপর পানি না পানির উপর জল, লালন সঙ্গীত

 ৯. বহুরূপে বিবেকানন্দ, পৃ: ১৮, স্বামী চেতনানন্দ, তৃতীয় সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা

১০. বাণী ও রচনা, প্রথম খণ্ড, পৃ: ১৫

১১. শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, দ্বিতীয় অধ্যায়, পঞ্চম মন্ত্র

১২. ঈশোপনিষদ্, প্রথম মন্ত্র

১৩. বাণী ও রচনা, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৬৪-৬৫, ২৩তম পুনর্মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা

১৪. অষ্টাবক্র গীতা, অনুবাদক: স্বামী ধীরেশানন্দ, পৃ: ৩৪, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা

১৫. উপনিষদের চারটি মহাবাক্য— ঋগ্বেদের ঐতরেয় উপনিষদের ‘প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, জ্ঞানই ব্রহ্ম; সামবেদের ছান্দোগ্য উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’ অর্থাৎ, তুমিই সেই (ব্রহ্ম); যজুর্বেদের বৃহদারণ্যক উপনিষদের ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, আমি ব্রহ্ম; অথর্ববেদের মান্ডুক্য উপনিষদের ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, আত্মা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম।

১৬. ‘অন-অল-হক’ অর্থাৎ, আমিই সেই সত্য। সুফী সাধক মনসুর-আল-হাল্লাজ, চরম সত্য উপলব্ধি করে বলেছিলেন এই কথা। কট্টরপন্থীদের নির্দেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়।

১৭. আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা পত্র, ৬ মে, ১৮৯৫

১৮. Practical Vedanta, Swami Vivekananda, P.- 50, Advaita Ashrama, Kolkata

১৯. বাণী ও রচনা, প্রথম খণ্ড, পৃ:২৭-২৮

>>>>>>>>>>>>>>>•<<<<<<<<<<<<<<<

Saturday 4 July 2020

আরও এক ৪ জুলাই

আরও এক ৪ জুলাই
            ~ শ্রী সৈকত



দোস্ত!
আবার এসো নতুনভাবে।
আমরা তোমাকে চিনে উঠতে পারিনি এখনও:
সবাই সুযোগ খোঁজে তোমার মধ্যে—
নিজের নিজের দলে টানতে চায় সবাই!
তবু আমি চেষ্টা করব তোমায় চিনতে। 
না পারলে, আবার এসে, নিজেই চিনিয়ে দিও নিজেকে। 
আজ এই ভারতে তোমাকে খুব দরকার। 
আর দরকার ওই বুড়োটাকেও, 
যাঁকে তুমি ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়েছিলে 
বেলুড় মঠের পুণ্যভূমিতে। 
ওই মানুষটাকে নিয়েও রাজনীতি হয় আজ… জানো হয়তো! 
তুমি হয়তো তখনই জানতে পেরেছিলে!
তাই তোমার শিষ্যকে বলেছিলে: 
আমার সমর্থনে কথা বলতে হবে না তোকে,
নিজের কাজ কর গে!
সত্যিই, তোমাকে ডিফেন্ড করার আমরা কে? 
তবু, তুমি তো বন্ধু আমার, প্রাণসখা তুমি। 
তাই যখন কেউ মিথ্যা দোষারোপ করে তোমার ওপর,
যখন নিজেরা সাধুর মুখোশ পরে তথ্যকে বিকৃত করে 
তোমাকে অন্যভাবে উপস্থাপিত করে, 
তখন দ্বিতীয় রিপুকে সংযত করতে পারি না আর।
ক্ষমা কোরো!

© শ্রী সৈকত
১৯ আষাঢ়, ১৪২৭
বহরমপুর

সর্বাধিক পছন্দের লেখা

পুরুষোত্তমের প্রতি

পুরুষোত্তমের প্রতি                                          ~ সৈকত দাস হে চির সুধীর, কৌশলী বীর, তব বাণী ছায়াতলে, অব...